ফলাফল প্রত্যাখ্যান করলেও আপাতত বড় কোনো কর্মসূচিতে যাবে না বিএনপি। সার্বিক পরিস্থিতি বুঝে ওঠার চেষ্টা করছে তারা। দলটি গত ৩০ ডিসেম্বর ভোটের দিন ও তার আগে যেসব অনিয়ম, কারচুপি এবং হামলা, মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে; তার আসনভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার উদ্যোগ নিয়েছে। তা গ্রন্থিত করে দলিল আকারে প্রকাশ করা হবে। এ ছাড়া নির্বাচনে নিজেদের ভুলত্রুটি, দুর্বলতাও চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিয়েছে।
এদিকে অবিলম্বে পুনর্নির্বাচনের দাবিতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা আগামীকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনে (ইসি) স্মারকলিপি দেবেন। এ লক্ষ্যে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের বৃহস্পতিবার সকালে গুলশানের বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত কী কী ঘটেছিল, তার সুনির্দিষ্ট বৃত্তান্ত প্রার্থীদের কাছ থেকে লিখিত আকারে সংগ্রহ করা হবে। এ লক্ষ্যে একটি খসড়া ফরম করা হয়েছে। তাতে তফসিল ঘোষণার পর থেকে প্রতীক বরাদ্দ পর্যন্ত, প্রতীক বরাদ্দ থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত কোন আসনে কতটি মামলা ও কতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, প্রচারের সময় কতটি হামলা এবং তাতে কতজন আহত হয়েছেন, ভোটের আগের রাতে কেন্দ্রগুলোতে কী হয়েছিল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বাসাবাড়িতে গিয়ে কী ধরনের হুমকি-ধমকি দিয়েছিলেন, ভোটের দিন কীভাবে এজেন্টদের কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া হয়, কেন্দ্র থেকে কীভাবে মারধর করে বের করে দেওয়া হয়েছে, ভোটে কী ধরনের কারচুপি করা হয়েছে—তা ফরমে জানতে চাওয়া হবে।
এই উদ্যোগের বিষয়ে এখনই বিএনপির কেউ কথা বলতে রাজি হননি। তবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত সোমবার স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, তাঁরা নির্বাচনে অনিয়ম, ভোট ডাকাতির তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে পরবতী করণীয় ঠিক করবেন।
বিএনপির নেতারা বলছেন, ৩০ ডিসেম্বরের এমন একটি নির্বাচন হয়েছে, যা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের চেয়েও ভয়াবহ। তাই ক্ষমতাসীন দল এই নির্বাচনের অনিয়ম, অসংগতি ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে যা যা করেছে, তার তথ্য-উপাত্ত সন্নিবেশিত করে দলিল আকারে সংরক্ষণ করা জরুরি। তারা মনে করছেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল এক রকম। আর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন মানুষের ভোটাধিকার হরণের নতুন নজির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে এই সরকার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যোগসাজশ করে এমন একটা নির্বাচন করল, এটা জাতির রাজনৈতিক ইতিহাস ও নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কময় ঘটনা বলে আমি মনে করি।’
বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, ক্ষমতাসীন মহাজোটের ২৮৮ আসনের বিপরীতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মাত্র সাতটি আসন পেয়েছে। বেশির ভাগ আসনেই ভোটের ব্যবধান লাখের বেশি। ভোটের এই অস্বাভাবিক ফলাফল মানুষ বিশ্বাস করছে না এবং তা সর্বত্র আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিএনপির নেতারা মনে করছেন, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ভোটের ব্যবধান যদি কাছাকাছি হতো বা বিএনপির আসনসংখ্যা আরও বাড়ত, তাহলে ভোট ভালো কি খারাপ হয়েছে, তা নিয়ে মানুষ কিছুটা বিভ্রান্ত হতো, অনেকের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা পেত।
এ ছাড়া ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির না যাওয়া, প্রধানমন্ত্রীর সংলাপে সাড়া না দেওয়া নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ছিল। তখন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এ নিয়ে অনেক সমালোচনা শুনতে হয়েছে। কিন্তু এবার বিএনপি নিজ থেকে সংলাপের প্রস্তাব পাঠিয়েছে, একাধিকবার সংলাপে গেছে, কোনো দাবি না মানা সত্ত্বেও নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। কিন্তু ভোটে বিএনপিকে মাঠে নামতে দেওয়া হয়নি। এখন নেতারা মনে করছেন, দলীয় সরকারের অধীন ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল, এই নির্বাচন তার পক্ষে শক্ত ভিত্তি দিয়েছে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, এবার নির্বাচনে না গেলে দল ভেঙে যেত। তবু কম প্রস্তুতিতে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিএনপিকে এই নির্বাচনে অংশ নিতে হয়েছে। সরকার চেয়েছিল নির্বাচন ঘিরে বিএনপিতে বিভক্তি ধরাতে। তা সম্ভব হয়নি। বিএনপির মনোনয়নবঞ্চিতদের একটি অংশকে সরকারের মিত্র আরেকটি জোটে নিয়ে নির্বাচিত করারও পরিকল্পনা ছিল সরকারি দলের। এক আসনে একাধিক প্রার্থীকে প্রাথমিক মনোনয়ন দেওয়ায় এই কৌশল সফল হয়নি বলে বিএনপি মনে করছে।
দলটির নেতাদের দাবি, ন্যূনতম সুষ্ঠু ভোট হলে ফলাফল ভিন্ন হতো। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সরকারি দল ফলাফল আগে থেকে নির্দিষ্ট করে রেখেছিল। ৩০ ডিসেম্বর ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
অবশ্য নির্বাচনের পর বিএনপির ভেতরে-বাইরে নেতৃত্বের দুর্বলতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ ছাড়া নির্বাচনে প্রস্তুতির ঘাটতি, কিছু আসনে দুর্বল প্রার্থী মনোনয়ন, বেশির ভাগ প্রার্থীর ঝুঁকি না নেওয়ার প্রবণতা, নেতা-কর্মীদের মাঠে নামাতে না পারা, মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত দল জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের ধানের শীষ প্রতীক দেওয়া—এসব নিয়েও সমালোচনা আছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে প্রকাশ্যে ভোট চুরি হয়েছে, আগের রাতেই ব্যালটে সিল দিয়ে বাক্স ভর্তি করে রাখা হয়েছে, সেখানে অন্য অজুহাত খোঁজা অর্থহীন।